নিউইয়র্কে আন্তর্জাতিক আবহে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন – বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭১ সালের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবী তুললেন আলোচকগণ

নিউইয়র্ক, ২৫ মার্চ ২০১৮:

আজ জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন ও  নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল এর যৌথ উদ্যোগে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার স্মরণে ‘গণহত্যা দিবস’পালন করা হয়। স্থানীয় সময় বিকেল তিনটায় আন্তর্জাতিক আবহে শুরু হয় এই অনুষ্ঠান। নিউইর্য়ক প্রবাসী বাঙালিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের আমন্ত্রিত বিদেশী অতিথিদের উল্লেখযোগ্য সমাগম ছিল অনুষ্ঠানটিতে।

এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ফ্রেন্ডস্ অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ডেভিড নালিন (David Nalin) এবং একই অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার কর্মী ডেভিড উইচবোর্ড (David Weisbroad), কসোভোর কনসাল জেনারেল রাষ্ট্রদূত মিজ্ টেউটা সাহাতকুইজা (Teuta Sahatquja), ভারতের কনসাল জেনারেল রাষ্ট্রদূত সন্দীপ চক্রবর্তী (Sandeep Chakravorty), যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিংহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ম্যাক্সিম এ. পেন্সকি (Dr. Maxim A Pensky) ও ড. নাদিয়া রুবাই (Dr. Nadia Rubaii), নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটের জ্যাকসান হাইটস্থ কলম্বিয়া-আমেরিকান প্রার্থী এবং নিউইয়র্ক ডেপুটি মেয়রের সাবেক অ্যাডভাইজর মিজ্ জ্যাসিকা র‌্যামস (Jessica Ramos), ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ অ্যালায়েন্সের সভাপতি লর্ড লিওমার বি. প্রম্পিরাডা (Lord Leomer B. Pomperada) সহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কূটনীতিকগণ।

উপস্থিত অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বের কাছে নৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে হেরে গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকার বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছিল। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয় ৩০ লাখ মানুষ। ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়। প্রায় এককোটি মানুষ আশ্রয় নেয় ভারতে”। রাষ্ট্রদূত মাসুদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন। গণহত্যা ও নৃশংসতার মত জঘণ্য অপরাধের আর ‘কখনোই, কখনোই এবং কখনোই যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে’ সে লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের দৃঢ় ভূমিকা রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদে, নিরাপত্তার সাথে এবং পূর্ণ মর্যাদা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করে যাচ্ছে মর্মেও তিনি উল্লেখ করেন।

কসোভোর কনসাল জেনারেল রাষ্ট্রদূত মিজ্ টেউটা সাহাতকুইজা বলেন “এটি শুনতে আমাদের যেমনই লাগুক কিন্তু অবশ্যই গণহত্যার সেই ভয়াবাহ ঘটনাগুলোকে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে। আমি এক্ষেত্রে রাষ্ট্রদূত মাসুদের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই জোনোসাইডের আর কখনোই যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে”। গণহত্যা প্রতিরোধে সকলকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত টেউটা। তিনি তাঁর দেশ কসোভোতে সংঘটিত গণহত্যার মর্মস্পর্শী বর্ণনা তুলে ধরেন।

ভারতের কনসাল জেনারেল রাষ্ট্রদূত সন্দীপ চক্রবর্তী বলেন, “আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান কর্র্তৃপক্ষ ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে বাংলাদেশে যে বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত করেছিল আমি সেই বেদনাদায়ক ঘটনা স্মরণ করছি এবং আজকের এই অনুষ্ঠানের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছি। ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে নির্মম গণহত্যা শুরু করার কারণেই ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল”। বাংলাদেশের গণহত্যা কেন আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত হয় নাই এমন প্রশ্ন টেনে তিনি বলেন, “এর কারণ, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভিন্ন মেরুর রাজনীতি শুরু হয় দেশটিতে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না”। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২০১৭ সালে গণহত্যা দিবস পালনের যে প্রস্তাব পাশ করেছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭১ সালের গণহত্যার স্বীকৃতিদানে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিংহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ম্যাক্সিম এ. পেন্সকি বলেন, “গণহত্যা দিবস পালন শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয় এটি বিশ্বের সকল নাগরিকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে অপারেশন সার্চ লাইটের নামে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিভৎস কাহিনীকে সকলেরই মনে রাখা উচিত”। গণহত্যা সংগঠনকারী কোন অবস্থায়ই আইনের থেকে পার পেতে পারেন না। এই ঘৃণ্যতম অপরাধের জন্য তাকে/তাদেরকে মৃত্যুরপূর্ব পর্যন্ত বিচারের মুখোমুখি হতে হবে মর্মে তিনি উল্লেখ করেন। প্রফেসর পেন্সকি তাঁর বক্তৃতায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার সাথে বাংলাদেশের গণহত্যার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন।

ফ্রেন্ডস্ অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধু ডেভিড নালিন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সংঘটিত গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবিদের স্মরণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ঐসময়ে তাঁর বাংলাদেশে অবস্থানকালীন ভয়াবাহ গণহত্যা নিজ চোখে দেখার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “অবশ্যই সকলকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে হবে। বিশ্বে গণহত্যার যেন আর কোন পুনরাবৃত্তি না হয়”। মিয়ানমার কর্তৃক সংঘটিত মিয়ামারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন ও গণহত্যার কথা তিনি উল্লেখ করেন। এক্ষেত্রে উদার মানবিক সহয়তা প্রদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ সরকার ও জনগণকে ধন্যবাদ জানান।

যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “জাতির পিতাকে যদি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা না হতো তাহলে অনেক আগেই দেশে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা যেত”।

জেনোসাইড-৭১ ফাউন্ডেশন, যুক্তরাষ্ট্র-এর সভাপতি ড. প্রদীপ রঞ্জন কর বিশ্বে গণহত্যার বিভিন্ন খতিয়ান তুলে ধরেন। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংঘটিত সাম্প্রতিক সহিংসতাকে তিনি জাতিগত নিধন এবং গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। উল্লেখ্য জেনোসাইড-৭১ ফাউন্ডেশন অনুষ্ঠানটিতে সহযোগিতা প্রদান করে।

অনুষ্ঠান শেষে আমন্ত্রিত অতিথিদের ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল মো: শামীম আহসান এনডিসি। তিনি বলেন, পৃথিবীতে আর যেন গণহত্যার ঘটনা না ঘটে। বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭১ সালের গণহত্যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়া সময়ের দাবী মর্মে তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত গণহত্যার শিকার মানুষের পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে সম্মান জানিয়ে একমিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানটিতে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে দেওয়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী পাঠ করা হয়।

***