শান্তিবিনির্মাণ ও টেকসই শান্তি বিষয়ক জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের সভা। ‘উন্নয়ন ব্যতীত শান্তি আসবে না আর শান্তি ব্যতীত কোন উন্নয়ন হতে পারেনা’ -জাতিসংঘে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি। প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ ও ‘স্টার অব দ্যা ইস্ট’ আখ্যা দেওয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

নিউইয়র্ক, ২৪ এপ্রিল ২০১৮ :

“উন্নয়ন ব্যতীত শান্তি আসবে না আর শান্তি ব্যতীত কোন উন্নয়ন হতে পারেনা” -আজ জাতিসংঘে ‘শান্তি বিনির্মাণ ও টেকসই শান্তি (Peacebuilding and Sustaining Peace)’ বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের সভায় অংশ নিয়ে একথা বলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি। উল্লেখ্য তিনি এই সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্ব করছেন।

নানাবিধ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিপীড়িত ও নিগৃহীত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দানের মতো সাহস ও মানবিকতা দেখিয়েছেন যার স্বীকৃতি স্বরূপ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ এবং ‘স্টার অব দ্যা ইস্ট’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন মর্মে উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি এই উপাধি প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেন, “প্রধানন্ত্রী বলেছেন আমরা যদি আমাদের ১৬০ মিলিয়ন মানুষকে খাওয়াতে পারি, তবে এই এক মিলিয়ন অসহায় রোহিঙ্গাদেরও খাওয়াতে পারবো, প্রয়োজনে আমরা ভাগ করে খাবার খাবো’।

জাতির পিতার অবিসংবাদিত নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যুদ্ধবিধ্বস্থ একটি দেশের ভগ্নস্তুপে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে গড়ে তুলেছেন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দানে তিনি ছিলেন বাঙালি জাতির কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সেই ধারাবাহিকতায়ই বাংলাদেশ আজ প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি মিয়ানমার থেকে জোর পূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য তার দরজা খুলে দিয়েছে”।

বিশাল এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, “এর সমাধান না হলে আমাদের অঞ্চল ও এর বাইরে এই রোহিঙ্গা সমস্যা শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তীব্র প্রভাব ফেলবে”। তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত ভাষণের পাঁচ দফা সুপারিশের কথা এবং কফি আনান কমিশনের রিপোর্টের শর্তহীন পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করেন।

টেকসই শান্তি বিনির্মাণে বাংলাদেশ গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “স্থায়ী শান্তি বিনির্মাণে আমাদের সরকার দারিদ্র্য বিমোচন, মানব উন্নয়ন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও  টেকসই উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। যুুদ্ধ ও সহিংসতার পরিবর্তে মানুষের মনে শান্তির সংস্কৃতি প্রোথিত করতে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ অনুসৃত ‘কালচার অব পিস’ পদক্ষেপের পাশাপাশি আমরা টেকসই শান্তি এজেন্ডাকেও এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি বাংলাদেশের যে প্রতিশ্রুতি তা এসেছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীরোচিত ইতিহাস থেকে। বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শিকার হয়েছিল মর্মে তিনি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন।

সন্ত্রাস দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, “প্রতিবেশী কোন দেশের বিরুদ্ধে যাতে কেউ আমাদের ভূখন্ড ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়ে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মৌলবাদ ও সহিংস চরমপন্থা দমনে আমরা সবসময়ই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নিবিড় অংশগ্রহণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছি”।

তিনি বলেন, এমডিজি অর্জনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসডিজিকে একীভূত করে এর বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের এই অব্যাহত উন্নয়নেরই স্বীকৃতি দিয়েছে মর্মে উল্লেখ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ একটি বিশ্বস্ত অংশীদার’ উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র বলেন, “বেসামরিক জনগণের সুরক্ষা প্রদানসহ সমস্যা সংঙ্কুল জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গত তিন দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমরা আমাদের সামর্থ্য ও পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে যাচ্ছি। সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে বাংলাদেশ সবসময়ই উচ্চকন্ঠ”।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিবিড় ও গতিশীল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অত্যাবশ্যক বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা খাতের অর্থবরাদ্দ না কমিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের জন্য বর্ধিত এবং সুনিশ্চিত অর্থায়ন নিশ্চিত করার জোর তাগিদ জানান।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি মিরোস্লাভ লাইচ্যাক এর আহ্বানে উচ্চপর্যায়ের এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বেলজিয়ামের রাজা; কলম্বিয়া, আয়ারল্যান্ড, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট; এস্তোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী; জর্জিয়া ও ক্রোশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী, ৪০টিরও বেশি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অন্যান্য দেশের মন্ত্রী, উপমন্ত্রীসহ ১৩১টি দেশ ও সংস্থার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন।

এছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ স্টেট বিষয়ক মন্ত্রী লর্ড আহমাদ (Lord Ahmad), নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ্ মারিয়ে এরিখসেন সরিডি (Marie Eriksen Soredie), এস্তোনিয়ার ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার ভায়নো রেইনআর্ট (Vaino Reinart), শসস্ত্র সংঘাতের সময় যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ বিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি মিজ প্রমীলা প্যাটেন (Pramila Patten) এর সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। এসকল বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়াও রোহিঙ্গা সঙ্কট ও আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

‘শান্তি বিনির্মাণ ও টেকসই শান্তি’ বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের এই সভায় অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন নিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল।

***