মিয়ানমার যেন সেই কাজটিই করে যাতে শিশুদের উপর সহিংসতার ভয়াবাহ চিত্র বিশ্ববাসীকে আর দেখতে না হয়’ – জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন

নিউইয়র্ক, ৯ জুলাই ২০১৮:

“হত-বিহ্বল, অসহায় এক রোহিঙ্গা শিশুকে কোলে নিয়ে সান্তনা দেওয়ার সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখাবয়বে বেদনাক্লিষ্ট ও ক্ষতবিক্ষত যে দৃশ্য ফুটে উঠেছিল সেই ছবি পরিণত হয়েছে বিশ্বে আইকনে। আমরা মিয়ানমারের নেতৃত্বের কাছে এটাই প্রত্যাশা করব তারা যেন সেই কাজটিই করে যাতে শিশুদের উপর সহিংসতার এমন ভয়াবাহ চিত্র বিশ্ববাসীকে আর দেখতে না হয়’ -আজ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে “শিশু ও শসস্ত্র সংঘাত: আজ শিশুদের সুরক্ষা দিন বন্ধ হবে আগামীদিনের সংঘাত Children and Armed Conflict: Protecting Children Today Prevents Conflicts Tomorrow)” বিষয়ক উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে একথা বলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের শিশুদের উপর যে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে তা কল্পনায় আনাও দূ:সাধ্য মর্মে উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ। মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‌্যাপোটিয়ার মিস্ ইয়াংহি লী সম্প্রতি কক্সবাজারে আসা সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের সাথে সরাসরি কথা বলার পর সাংবাদিকদের কাছে যে ভয়াবাহ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিলেন তা স্থায়ী প্রতিনিধি উদ্বৃত করেন। লী বলেছিলেন, “আমি অত্যন্ত ভীত-সন্তস্ত্র হয়ে পড়লাম যখন একজন নারী আমাকে বলল, তার ১২ বছরের ছেলেটি পারিবারিক মৎস্য হ্যাচারি দেখতে গেলে তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী। আর এই ঘটনার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বলেছে ভেরিফিকেশন কার্ড গ্রহণ ব্যতিত তারা কোথাও যেতে পারবে না। শিশুদের এমন শোচনীয়, নৃশংস হত্যার নজীর আর হতে পারে না”।

রাষ্ট্রদূত মাসুদ নিরাপত্তা পরিষদের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের কথা উল্লেখ করে বলেন, “শিশুদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা যে কত তীব্র হতে পারে তা নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিগণ বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাঁদের সাম্প্রতিক পরিদর্শনকালে নিজ চোখে দেখে এসেছেন”। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত বলেন, “২০১৭ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সাত লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে যার প্রায় ৫৮ ভাগ শিশু। এ পর্যন্ত এতিম শিশু পাওয়া গেছে ৩৬ হাজার ৩৭৩ জন। মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছে এমন শিশু রয়েছে ৭ হাজার ৭৭১ জন। পিতা-মাতাহীন এসকল শিশুরা আজ মানবপাচার, যৌন নির্যাতন এবং বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডের শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই নাজুক অবস্থায় রয়েছে”।

তিনি আরও জানান, প্রতিদিন ক্যাম্পসমূহে জন্ম নিচ্ছে ৬০ জন শিশু। এরমধ্যে কিছু জন্ম নিয়েছে যৌন সহিংসতার মতো পুরনো যুদ্ধাস্ত্রের শিকার হয়ে। জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্টীকে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সাথে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায় এসকল শিশুদের কথা উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ। মানবিক সাহায্য প্রদানকারী সংস্থাসমূহকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য টিকা প্রদান, পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন, মনো-সামাজিক সহযোগিতা ও বিনোদনের সুবিধাসহ ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে মর্মে জানান স্থায়ী প্রতিনিধি।

রাষ্ট্রদূত মাসুদ জাতিসংঘের শিশু ও সশস্ত্র-সংঘাত বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধির কাছে আহ্বান জানান, তিনি যেন তাঁর আপডেটেড রিপোর্টে এসংক্রান্ত বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের জন্য সুস্পস্ট সুপারিশমালা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই শিশুদের নিজভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারসহ সকল অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিতে অনুকুল, টেকসই ও বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মিয়ানমারের কোনভাবেই দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও লিক্টেনস্টেইন (Liechtenstein) সহ জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্যরাষ্ট্র মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর সংঘটিত সহিংসতা বিশেষ করে নারী ও শিশুদের হত্যা, ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতার কথা তুলে ধরেন। শসস্ত্র-সংঘাতের সময় শিশুদের প্রতি মানবিকতার সর্বোচ্চ লঙ্ঘনকারীদের তালিকায় মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষা বাহিনী সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে লিক্টেনস্টেইন এর প্রতিনিধি জানান শিশুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয় ও অ-রাষ্ট্রীয় সহিংসতা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীকে চাপের মধ্যে রাখবে। নিরাপত্তা পরিষদের জুলাই মাসের সভাপতি সুইডেন এই উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে যাতে অংশ নেয় ৯০টিরও বেশী দেশ।

***