প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে জানে বাংলাদেশ -জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরামে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন

নিউইয়র্ক, ১৯ জুলাই ২০১৮ :

“প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে জানে বাংলাদেশ”-জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরাম (এইচএলপিএফ) -এ কান্ট্রি স্টেটমেন্ট প্রদান কালে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কীভাবে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে তা উল্লেখ করার একপর্যায়ে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন একথা বলেন।

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন “এর সবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে। এমডিজি বাস্তবায়নের সফল অভিজ্ঞতা নিয়েই এসডিজি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ। আমরা এসডিজি’র লক্ষ্যসমূহকে দেশের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে একীভূত করেছি। সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে এসডিজি’র বাস্তবায়ন সমন্বয় করা হচ্ছে, আর এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে এসডিজি’র প্রতি আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি কতটা দৃঢ়। গত বছর ভলান্টারি ন্যাশনাল রিভিউতে অংশ নিয়ে এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরেছি”।

স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “সমাজের সকলকে সম্পৃক্ত করে (whole of the society approach)’ এসডিজি’র লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে বাংলাদেশ”।

রাষ্ট্রদূত মাসুদ উল্লেখ করেন, “এসডিজি বাস্তবায়নে প্রথম আনুষ্ঠানিক দলিল হিসেবে বাংলাদেশে মন্ত্রনালয়/বিভাগ সমূহের জন্য লক্ষ্য নির্দিষ্ট মানচিত্র প্রস্তুত করেছে। এছাড়া জাতীয় কর্মপরিকল্পনাও প্রস্তুত করা হয়েছে। এসডিজি ও অন্যান্য জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যের বাস্তবায়ন নিরীক্ষণের জন্য একটি ডেটা সংগ্রহস্থল তৈরিতে এসডিজি ট্রাকার সৃষ্টি করা হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে জ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এ পরিণত করতে আমরা ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছি”।

বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়নে ‘পুঁজির সরবরাহ’, ‘ডেটা গ্যাপ’, ‘চতুর্থ শিল্প বিল্পবের প্রেক্ষাপটে বৈষম্য মোকাবিলা ও উপযুক্ত চাকুরির বাজার সৃজন’ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জসমূহের কথা উল্লেখ করেন স্থায়ী প্রতিনিধি। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাব বাংলাদেশের কৃষি খাত ও খাদ্য নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে মর্মেও উল্লেখ করেন তিনি।

রাষ্ট্রদূত বলেন, “এসকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরকে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে ব্যাপক সংস্কারের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে যাতে নতুনভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সুবিধা আমরা গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু এতে বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন”।

বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মর্মে উল্লেখ করেন স্থায়ী প্রতিনিধি। এলডিসি থেকে উত্তরণ টেকসই এবং এসডিজি’র বাস্তবায়ন সফল করতে উন্নয়ন ও বাণিজ্য অংশীদারদেরকে সহায়তায় এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

উল্লেখ্য “টেকসই ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম সমাজে রূপান্তর (Transformation towards sustainable and resilient societies)” প্রতিপাদ্য নিয়ে গত ৯ জুলাই ২০১৮ থেকে শুরু হওয়া জাতিসংঘের এবারের হাই-লেভেল পলিটিক্যাল ফোরাম (এইচএলপিএফ) মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণা (Ministerial Declaration) গ্রহণের মধ্য দিয়ে গতকাল (১৮ জুলাই) শেষ হয়েছে। এইচএলপিএফ এর শেষ তিন দিন অর্থাৎ গত ১৬ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই ছিল মন্ত্রী পর্যায়ের সেগমেন্ট। বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ১৬ জুলাই মন্ত্রী পর্যায়ের সেগমেন্টের উদ্বোধনীতে অংশগ্রহণ করেন।

এবারের এইচএলপিএফ-এ বাংলাদেশের অবদান ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ (ইকোসক) এর প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ ও অষ্ট্রেলিয়াকে এইচএলপিএফ -এর আউটকাম ডকুমেন্টস্ অর্থাৎ মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণার খসড়া তৈরির জন্য কো-ফ্যাসিলিটেটর নিয়োগ করে। বাংলাদেশ ও অষ্ট্রেলিয়ার তৈরি খসড়া ডকুমেন্টস্ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের রিভিউর মাধ্যমে গতকাল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হলো।

এবারের মন্ত্রী পর্যায়ের ঘোষণায় যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তা হলো: ক) এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে উন্নত দেশগুলোর আর্থিক, কারিগরী ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান। খ) জলবায়ু পরিবর্তন রোধে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নসহ অন্যান্য সকল বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। গ) দূর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের জন্য সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। ঘ) লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুতে রাষ্ট্রসমূহের বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন। ঙ) এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আদ্দিস আবাবা অ্যাকশন প্লান বাস্তবায়নের উপর গুরুত্বারোপ। চ) এসডিজি’র লক্ষ্য ৬, ৭, ১১, ১২, ১৫ ও ১৭ বাস্তবায়নে অধিকতর গুরুত্বারোপ এবং এক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জসমূহ দূর করতে পদক্ষেপ গ্রহণ। ছ) এসডিজি-১৭ এর অধীনে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা কার্যকর করতে জোরালো ভাষায় সমর্থন। জ) প্রযুক্তি খাতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর সহায়তা প্রদানের নির্দেশনা।

এইচএলপিএফ উপলক্ষ্যে একাধিক সাইড ইভেন্টের আয়োজন করে বাংলাদেশ। ‘পয়:নিষ্কাশনে অংশগ্রহণমূলক দৃষ্টিভঙ্গি: বাংলাদেশ থেকে শেখা (Participatory Approaches to Sanitation: Learning from Bangladesh)’, ‘ডেটা বিপ্লবে পিছনে পড়ে থাকবে না কেউই (Leaving No One Behind Through Data Revolution)’ এবং ‘টেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণ-পথ নির্বিঘ্ন করতে স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে সহযোগিতা প্রদান (Supporting LDCs For Smooth Transition Towards Sustainable Graduation)’ শীর্ষক সাইড ইভেন্টসমূহে যোগ দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বাংলাদেশে এসডিজি বাস্তবায়ন বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আযম এবং সংশ্লিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকতাসহ শিক্ষাবিদ, উন্নয়নকর্মী ও গবেষকগণ।

বাংলাদেশের এসকল সাইড ইভেন্টে যোগ দেন জাতিসংঘ সদরদপ্তর, জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রসমূহ, থিংঙ্ক ট্যাংক, নীতি নির্ধারক, বিষয় বিশেষজ্ঞ ও গবেষকসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিগণ। যাদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং স্বল্পোন্নত, ভূবেষ্টিত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রসমূহের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ (High Representative for the LDC, LLDC & SIDS) মিজ্ ফেকিতামোইলোয়া কাতোয়া ইউতোইকামানু (Fekitamoeloa Katoa Utoikamanu), ভূটানের অর্থমন্ত্রী নামগে দরজী (Namgay Dorji), জাতিসংঘে নিযুক্ত মালদ্বীপের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ড. আলী নাসির মোহামেদ (Ali Naseer Mohamed) ও ক্যাবো ভারদে’র স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত জোসে লুইস ফিয়ালহো রোচা (Jose Luis Fialho Rocha), ইউএনডিপি’র এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক ও জাতিসংঘের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল হাওলিয়াং ঝু (Haoliang Xu), জাতিসংঘের এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কমিশন (ইউএন-এসকাপ)-এর ডেপুটি এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি কাভে জাহেদি (Kaveh Zahedi), জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভোলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) এর প্রধান রোনাল্ড মল্লিরুস্ (Ronald Mollerus) ,ইউএন-ওএইচআরএলএলএস এর পরিচালক মিজ হেইদি ফক্স (Heidi Schroderus-Fox), জাতিসংঘের ইনস্টিটিউট ফর ট্রেনিং এন্ড রিসার্চ এর এক্সিকিউটিভ এডিটর নিখিল শেঠ (Nikhil Seth), জাতিসংঘের ইকোনমিক ও স্যোসাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক স্টীফান স্কীউইনফেস্ট (Stefan Schweinfest), নরওয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের সিনিয়র অ্যাডভাইজর মিজ্ লাইভ মারগ্রেথ রগনিরুড (Margrethe Rognerud), বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র ইকোনমিস্ট ওমর সিরাজউদ্দিন।

***