জাতিসংঘ সদরদপ্তরে দ্বিতীয় বারের মতো উদযাপিত হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস – বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবীর কথা পুনরুল্লেখ করলেন এমপি ফারুক খান

নিউইয়র্ক, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮:

আজ দ্বিতীয়বারের মতো জাতিসংঘ সদরদপ্তরে যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক আবহে উদযাপন করা হল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘ সদরদপ্তর, ইউনেস্কোর নিউইয়র্কস্থ কার্যালয়, নিউইয়র্ক সিটি মেয়র অফিস এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনসহ  কলম্বিয়া, ফিজি ও তানজানিয়া মিশনের যৌথ উদ্যোগে স্থানীয় সময় বিকাল পাঁচটায় জাতিসংঘ সদরদপ্তরের কনফারেন্স রুম-৪ এ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

নিউইয়র্ক সফররত বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি বাংলাদেশ ডেলিগেশনের পক্ষে এসভায় বক্তব্য প্রদান কালে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবীর কথা পুনরুল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে বাংলাকে জাতিসংঘের অন্যতম দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য প্রস্তাবনা পেশ করেছেন। বাংলা বিশ্বের ষষ্ঠ বা সপ্তম জনপ্রিয় ভাষা, যাতে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ কথা বলে”। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাবনা বিবেচনায় আনতে তিনি উপস্থিত জাতিসংঘের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

ভাষা আন্দোলন সংগঠনে এবং আন্দোলনকে বেগবান করতে তরুন ছাত্রনেতা হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভূমিকা রেখেছেন এমপি ফারুক খান তা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে অর্জন করেছিল মহান স্বাধীনতা”।

তিনি আরও বলেন, “বিশ্বসভায় বাংলাভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে জাতির পিতা ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো বাংলায় ভাষণ দেন যা অনুসরণ করে প্রতিবছর সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দিয়ে যাচ্ছেন তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা”। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথমবারের সরকারের সময় ২০০০ সালে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং তাঁরই প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ২০০১ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট যা বিশ্বের সকল ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা এবং ভাষা সংরক্ষণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে মর্মে এমপি ফারুক খান উল্লেখ করেন।

এর আগে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-এই দুই পর্বে বিভক্ত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ আয়োজনের শুরুতে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাগত ভাষণ দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। রাষ্ট্রদূত মাসুদ দিবসটি উপলক্ষে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণীর অংশবিশেষ উদ্বৃত করে বলেন “মহান একুশে ফেব্রুয়ারির সেই রক্তাক্ত গৌরবের সুর বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে আজ বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মানুষের প্রাণে অনুরণিত হচ্ছে”।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কো প্রদত্ত এবারের প্রতিপাদ্য ‘ভাষাগত বৈচিত্র এবং বহুভাষাবাদ: স্থায়িত্ব ও শান্তির মূল ভিত্তি’ উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “টেকসই শান্তি ও এজেন্ডা ২০৩০ বাস্তবায়নের সাথে এটি ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত”।

রাষ্ট্রদূত উদ্বেগের সাথে বলেন, “ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবে যা এজেন্ডা ২০৩০ এর সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবী, আর তা হলেই হয়তো আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষের ‘কেউ পিছনে পড়ে থাকবে না’ এই অন্যতম প্রতিপাদ্য অর্জন করতে পারবো”।

অনুষ্ঠানটির আলোচনা পর্বে অংশ নেন জাতিসংঘে নিযুক্ত কলম্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিজ্ মারিয়া ইম্মা মেহিয়া ভেলেজ (María Emma Mejía Vélez), তানজানিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মডেস্ট জে. মিরো (Modest J. Mero), ফিজি’র চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স লুকে দাউনি ভালু, জাতিসংঘের জেনারেল এসেম্বিলী ও কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিজ্ ক্যাথরাইন পোলার্ড (Catherine Pollard) এবং ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক ইনফরমেশন ও গ্লোবাল কমিউনিকেশনের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অ্যালিসন স্মেল (Alison Smale)।

আলোচকগণ পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার সংরক্ষণ ও সুরক্ষা, বহুভাষিক শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়া এবং ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বাহন হিসেবে গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তাঁরা স্ব স্ব দেশের ভাষাগত বৈচিত্র, এর সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গৃহীত পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।

জেনারেল এসেম্বিলী ও কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মিজ্ ক্যাথরাইন পোলার্ড ভাষাগত বৈচিত্র ও বহুভাষাবাদের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, “আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার কার্যকর সংরক্ষণ আমরা কীভাবে করবো যদি নিজেকে বুঝাতে ও অপরকে বুঝতে না পারি, কীভাবে আমরা সকলকে নিয়ে টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে অগ্রসর হবো যদি না স্থানীয় অংশীজনদের ভাষার ব্যবধান বিবেচনায় না আনি এবং সহিংসতার শিকার কোনো ব্যাক্তি যে ভাষায় কথা বলছে তা যদি বুঝতে না পারি তাহলে কীভাবে আমরা তার মানবাধিকার সংরক্ষণ করবো”।

ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক ইনফরমেশন ও গ্লোবাল কমিউনিকেশনের প্রধান জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অ্যালিসন স্মেল বলেন, “আমরা যদি গোটা বিশ্বকে প্রকৃতভাবে সংযুক্ত করতে চাই, তবে অবশ্যই তা আমাদের স্থানীয় ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষার মাধ্যমে করতে হবে কারণ মাতৃভাষার মাধ্যমেই মানুষ নিজেকে সর্বোচ্চভাবে প্রকাশ করতে পারে”। তিনি ডিপিআই-এর যোগাযোগ ভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করেন। ‘আমরা মানুষের জন্য (We the Peoples)’ – প্রতিপাদ্য নিয়ে জাতিসংঘের যাত্রা শুরু হয়েছে মর্মে উল্লেখ করে মিজ্ স্মেল বলেন, “মানুষের কথা বলার অধিকারকে বৃদ্ধি করে আমরা তা করতে পারি”।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ও নিউইয়র্ক সিটির মেয়রের বাণী অনুষ্ঠানটিতে পাঠ করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদদের বিদেহী আত্মার স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার উপর রচিত একটি প্রামাণ্য ভিডিও অনুষ্ঠানটিতে পরিবেশন করা হয়।

বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পর্বের সুচনায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রী চিন্ময় গ্রুপ ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ নিয়ে থিম সঙ্গীত এবং শ্রী চিন্ময় রচিত একটি কবিতা বিভিন্ন ভাষায় আবৃত্তি করেন। অনুষ্ঠানে ইউএন চেম্বার মিউজিক সোসাইটি সংগীত পরিবেশন করেন। তাছাড়া জাতিসংঘের জেনারেল এসেম্বিলি ও কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগে কর্মরত ভাষা কর্মীগণ বিভিন্ন ভাষায় মানবাধিকার চার্টারের অংশ বিশেষ পাঠ করেন।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়ক সফররত বাংলাদেশের সংসদ সদস্য সংসদ ফখরুল ইমাম, আনোয়ারুল আবেদীন খান ও রোখসানা ইয়াসমিন ছুটি। জাতিসংঘে নিযুক্ত সদস্য দেশগুলোর স্থায়ী প্রতিনিধি ও প্রতিনিধিগণ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালি, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং মিডিয়া কর্মীগণ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

 ***