রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি আন্তর্জাতিক আইনের পূর্ণ লঙ্ঘন করে কেউ যেন এ অপরাধের দায় থেকে মুক্তি পেয়ে না যায় – জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।

নিউইয়র্ক, ১৭ মে ২০১৮:

“আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মানবাধিকার আইনের পূর্ণ লঙ্ঘন করেও নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপের অনুপস্থিতির কারণে জাতিসংঘের কোন সদস্য রাষ্ট্র কৃত অপরাধের দায় থেকে মুক্তি পেয়ে না যায়” – আজ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইনকে সমুন্নত রাখা’(Upholding International Law within the context of the maintenance of international peace and security) বিষয়ক এক উন্মুক্ত বিতর্কে বক্তব্য প্রদানকালে একথা বলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।

তিনি তাঁর বক্তৃতায় ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রদত্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ উদ্ধৃত করে বলেন, “মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি অপরিহার্য…শান্তি অবশ্যই হতে হবে স্থায়ী, আর এই স্থায়ী শান্তির ভিত্তি হবে ন্যায় বিচার”। জাতির পিতার এই বক্তব্যকে অনুসরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালে জাতিসংঘের ‘হাই-লেভেল ইভেন্ট অব রুল অব ল’ তে অংশগ্রহণ করে যে বক্তব্য দেন স্থায়ী প্রতিনিধি তার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে বলেন, “বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে ‘আইনের শাসনের ন্যায়সঙ্গত, সমতাভিত্তিক ও ন্যায্য ব্যবহার’; ‘জাতিসংঘ সনদ ও এর ন্যায়বিচারের নীতি’; ‘আন্তর্জাতিক আইন’ এবং ‘আন্তর্জাতিক আদালত’ এর উপর মানবজাতির বিশ্বাসের পুন:স্থাপন প্রয়োজন। আর শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইনী ব্যবস্থা ও বহুপাক্ষিক চুক্তিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রাখতে হবে এবং বহুপাক্ষিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক আইনের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহারের প্রতি সমর্থন জানাতে হবে”।

রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি আমাদের নেতাদের এই দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা মাথায় রেখেই আমরা আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বা অন্য কোন রাষ্ট্রের সাথে যে কোন বিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তর্জাতিক আইনী প্রক্রিয়ার আশ্রয় নিয়েছি। ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

রোহিঙ্গা সঙ্কটের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, “এটি সর্বজন স্বীকৃত যে রোহিঙ্গাদের উপর সৃষ্ট সহিংস অপরাধের বিচার ও দায়ভায় নির্ধারণের প্রশ্ন বিশেষ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই-কমিশনার যাকে ‘জাতিগত নির্মূলের টেক্সবুক উদাহরণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও স্বপ্রনোদিত প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির সাথে একই সূত্রে গাঁথা”।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরকালে রোহিঙ্গাদের যে ভয়াবাহ মানবিক বিপর্যয় নিজেদের চোখে দেখে এসেছেন তার উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি এই সঙ্কটের সমাধানে আন্তর্জাতিক আইনের পূর্ণ ব্যবহারের প্রতি আহ্বান জানান। মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত এই অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরষিদের কাছে ন্যায় বিচার ও দায়বদ্ধতা নিরূপণের জন্য যে জোরালো আবেদন জানিয়েছেন তা নিরাপত্তা পরিষদ বিবেচনা করবে মর্মে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মে মাসের সভাপতি পোলান্ড এর সভাপতিত্বে আয়োজিত এই সভায় নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্যদেশসহ ৭৫টিরও বেশী দেশের রাষ্ট্রদূত/ প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভায় আরও বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘ মহাসচিবের সেফ দ্য কেবিনেট (Chef de cabinet) মিজ্ মারিয়া লুইজা রিবিরো ভিয়োট্টি (Maria Luiza Ribeiro Viotti), ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজ এর সিনিয়র বিচারক ও প্রেসিডেন্ট এমিরিটাস হিসাশি ওয়াদা (Hisashi Owada) এবং ইন্টারন্যাশনাল রেসিডুয়াল মেকানিজম ফর ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনালস্ এর প্রেসিডেন্ট বিচারক থিয়োডোর মেরোন Theodor Meron)।

বক্তাগণ আন্তর্জাতিক আইনকে জাতিসংঘের ‘হৃদয়’ বলে অভিহিত করেন। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতা রোধ, মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং স্থায়ী শান্তি বিনির্মাণে আন্তর্জাতিক আইনের যথাযথ প্রয়োগের কোন বিকল্প নেই বলেও অভিমত প্রকাশ করেন বক্তাগণ।

***