জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে উন্মুক্ত ব্রিফিং – জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের টেকসই, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য নিরাপত্তা পরষিদকেই দায়িত্ব নেওয়ার আহ্বান জানালেন বক্তাগণ

নিউইয়র্ক, ২৮ আগস্ট ২০১৮:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার সাম্প্রতিক এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আজ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এক উন্মুক্ত ব্রিফিং -এর আয়োজন করে। সভাটির আয়োজক ছিল নিরাপত্তা পরিষদের চলতি আগস্ট মাসের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাজ্য। উন্মুক্ত এই ব্রিফিং অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেজ (António Guterres), ইউএনডিপি’র অ্যাসোসিয়েট অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তেগেগনিঅর্ক গেট্টু (Tegegnework Gettu) এবং ইউএনএইচসিআর এর শুভেচ্ছা দূত ও বিশিষ্ট অভিনেত্রী মিজ্ কেইট্ ব্লানশেট (Cate Blanchett)। সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্যের কমনওয়েলথ্ ও জাতিসংঘ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী লর্ড তারিক মাহমুদ আহমাদ (Lord Tariq Mahmood Ahmad)। নিরাপত্তা পরিষদের পনেরটি সদস্য রাষ্ট্রের বাইরে এই সভায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বক্তব্য প্রদান করে।

জাতিসংঘ মহাসচিব গত জুলাই মাসে তাঁর কক্সবাজার সফরের সময় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের যে সকল মর্মস্পর্শী বর্ণনা শুনেছেন তা এই সভায় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “ইতোমধ্যে এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই সমস্যা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। নিরাপত্তা পরিষদ প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট গ্রহণে একতা দেখিয়েছিল, এই একতা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন যদি আমরা যথাযথ কাজের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দাবী পূরণ করতে চাই”। মহাসচিব গুতেরেজ কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা পূনরুল্লেখ করেন। জাতিসংঘ এবং এর বিভিন্ন সংস্থাসমূহকে রাখাইন প্রদেশে বাধাহীন প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। একবছর ধরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাঁর ব্যক্তিগত পদক্ষেপসহ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলোর উল্লেখ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

‘আমরা যেন আর ব্যর্থ না হই’এই আহ্বান জাননিয়ে ইউএনএইচসিআর এর শুভেচ্ছা দূত মিজ্ কেইট্ ব্লানশেট বলেন রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদকেই দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক মতভেদের উর্ধ্বে উঠে নিরাপত্তা পরিষদের সকল সদস্যকে কাজ করার আহ্বান জানান ব্লানশেট।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন গত একবছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রেখে এর সমাধানে কাজ করে যাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি ধন্যবাদ জানান।

রাষ্ট্রদূত মাসুদ গত বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উত্থাপিত পাঁচ দফা সুপারিশের কথা উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সুপারিশমালার ভিত্তিতেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হতে পারে মর্মে উল্লেখ করেন তিনি।

রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, “রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পদক্ষেপসমূহের টেকসই বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও উদারভাবে এগিয়ে আসতে হবে তা না হলে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটি মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিবে”।

‘গণহত্যার উদ্দেশ্যে নিয়ে পূর্ব-নির্ধারিত এবং সুপরিকল্পিত পদ্ধতি অনুসরণ করেই অপরাধীরা এই হীন অপরাধ সংঘটিত করেছে’ -মানবাধিকার কাউন্সিলের স্বাধীন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্টের এই উদ্বৃতি উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত মাসুদ। তিনি বলেন, মিয়ানমারের ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করার জন্য মিয়ানমারকেই এগিয়ে আসতে হবে।  রাখাইন প্রদেশে স্থায়ী প্রত্যাবসনের পরিবেশ তৈরি হলেই কেবল বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা ফিরে যাওয়ার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসবে। প্রত্যাবসনের পরিবেশ তৈরিতে তিনি মিয়ানমার কর্তৃক চারটি আশু পদক্ষেপ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেন:

১.            রাখাইন প্রদেশের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম ও শহরগুলোতে প্রয়োজনীয় মানবিক ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর-কে বাধাহীনভাবে প্রবেশাধিকার দিতে হবে যা মিয়ানমারের সাথে সম্পাদিত তাদের সমঝোতা স্মারকে স্পস্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

২.           বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে আটকে থাকা কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়া এবং ফেরত না নেওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের পক্ষ থেকেই তাদের মানবিক সহায়তা প্রদান করতে হবে।

৩.          রাখাইন স্টেটের আইডিপি ক্যাম্প উন্মুক্ত করে দিতে হবে এবং সেখানে আটক মানুষেরা যাতে নিজ বাসভূমিতে বা তাদের অন্য কোন পছন্দনীয় স্থানে পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে টেকসইভাবে প্রত্যাবর্তন করতে পারে তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

৪.           রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন সম্প্রদায় মধ্যে বিশ্বাস ও পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং হিংসা উদ্রেককারী বক্তব্য ছড়ানো যা সহিংসতা ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে তা দমন করতে হবে।

রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফরের কথা উল্লেখ করেন। সদ্য প্রয়াত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান এর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে রাষ্ট্রদূত মাসুদ বলেন, আমরা যদি কফি আনান কমিশনের পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে পারি তবেই তার বিদেহী আত্মার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে।

জোরপূর্বক বাস্ত্যুচ্যুত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে দু:খ ও দুস্বপ্নের এক বছর উপলক্ষে কক্সবাজারের ক্যাম্পে জড় হওয়া রোহিঙ্গা নর-নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের হাতে বিভিন্ন শ্লোগান লেখা প্লাকার্ডের একটি লেখা “এক বছর কেঁদেছি, এখন আমি ক্রোধান্বিত” উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, “এই শোকানুভূতি এবং ক্রোধের প্রতিধ্বনি আজ এই কাউন্সিলে আমরা শুনতে পেলাম”। তিনি প্রত্যাশা করেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আস্থা পুনরুদ্বারের মাধ্যমে তাদেরকে স্বেচ্ছায় নিজভূমিতে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নিবে।

জাতিসংঘে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত তাঁর বক্তব্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।

***